
দক্ষিণ দিনাজপুর: এক সময় চোলাই মদের দাপটে নাজেহাল ছিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা। জেলা পুলিশের লাগাতার অভিযানে বর্তমানে বহু এলাকা কার্যত চোলাইমুক্ত। ভেঙে ফেলা হয়েছে একের পর এক চোলাইয়ের ঠেক, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভাটিখানা। কিন্তু তাতেও থামেনি নেশার করাল গ্রাস। চোলাইয়ের জায়গা নিয়েছে আরও ভয়ংকর ও মারাত্মক নেশা ঘুমের ওষুধ, মরফিনজাত কাশির সিরাপ, ব্রাউন সুগার এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনকভাবে আঠা।
জেলায় নেশা সামগ্রীর তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সন্ধ্যা নামলেই কিছু নির্জন এলাকা, স্কুল-কলেজের মাঠ, সিনেমা হলের আশপাশ, নদীপাড়, শ্মশান এলাকা কিংবা পার্ক হয়ে উঠছে নেশাখোরদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এই নেশার শিকার হচ্ছেন শুধু প্রাপ্তবয়স্করা নন, কলেজ পড়ুয়া, স্কুল পড়ুয়া এমনকি শিশুরাও।
হিলি, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর-সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে দিনে দিনে বাড়ছে নেশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা। বালুরঘাট শহরের বাসস্ট্যান্ড, কলেজপাড়া নদীপাড়, শ্মশান এলাকা সংলগ্ন পার্ক কিংবা গঙ্গারামপুরের হাইস্কুল পাড়া, রবীন্দ্রভবন এলাকা, গলাকাটা কলোনি, বুনিয়াদপুর চৌমাথা মোড় শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই অবাধে মিলছে মাদক। অভিযোগ, মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে এক পুরিয়া ব্রাউন সুগার।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, পুলিশের কাছে এইসব তথ্য থাকা সত্ত্বেও নজরদারির অভাবে রমরমিয়ে চলছে মাদক ব্যবসা। ওষুধের দোকানগুলিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে ঘুমের ওষুধ ও কাশির সিরাপ। নেশায় এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে যে, ঘুম না আসায় মাথা ঝিমঝিম করে, একটি ঘুমের আশায় মানুষ ছুটছেন ওষুধের দোকানে। ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য না থাকায় সহজেই মিলছে নিষিদ্ধ ওষুধ। এর ফলে একদিকে যেমন ওষুধ বিক্রেতাদের লাভের অঙ্ক বাড়ছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্রাউন সুগারের বাজার।
তবে প্রশাসন ও সমাজের কাছে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে আঠার নেশা। মুদিখানা থেকে পান-সিগারেটের দোকান সর্বত্রই সহজলভ্য এই আঠা। নেশাগ্রস্তরা প্লাস্টিকের মধ্যে আঠা ঢেলে নাক-মুখ দিয়ে টেনে নিচ্ছে, আর তাতেই তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ আসক্তি। এই নেশার শিকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্কুল ও কলেজ পড়ুয়ারা, এমনকি অল্প বয়সী শিশুরাও রয়েছে। নেশাগ্রস্তদের বক্তব্য, “পকেটে ভরে নিলেই হল। আড়ালে গিয়ে নেশা করার কোনও ঝামেলা নেই।”
চায়ের দোকানেও গোপনে চলছে কাশির সিরাপের আসর। অবৈধভাবে কাফ সিরাপ পাচারের ঘটনায় একাধিকবার পাচারকারীরা পুলিশের জালে ধরা পড়লেও ব্যবসার রাশ টানা যাচ্ছে না। জেলা পুলিশের কর্তাদের দাবি, যেসব এলাকায় দোকানদাররা নেশার ওষুধ বিক্রি করতে অস্বীকার করেছেন, সেখানেই বেড়েছে ব্রাউন সুগারের বিক্রি। গত কয়েক মাসে একাধিক ড্রাগ প্যাডলার ও সেলারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবুও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে এই নেশার ঠেকগুলো কোথায় লুকিয়ে? প্রশাসনের নজরদারি কি যথেষ্ট? সমাজ ও প্রশাসন একযোগে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে দক্ষিণ দিনাজপুরের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে ভয়াবহ বিপদের দিকে এগোচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।














